Rose Good Luck পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১৪) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:২৩:২২ রাত



মিথিলা!

ছোট খালা বাচ্চা এত পছন্দ করতেন। আমাদের বাসায় এলে চাঁপাকে কোলে নিয়ে তার দিন যেত। কতভাবে সাজাতেন ওকে। প্রত্যেকবার আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। জামা, জুতো, ঝুমঝুমিওয়ালা চুড়ি, রূপার নূপুর, স্বর্ণের চেইন কিছু বাদ ছিল না।

খালা প্রায়ই বলতেন, 'আমার মেয়েই লাগবে'।

কিন্তু বিয়ের বছর দুয়েক গিয়েও বাচ্চা হলো না। খালা বাচ্চার জন্য অস্থির হচ্ছিলেন। মা মাঝে মাঝে হাসতেন, ' দেরী আবার কী? তোর বয়স কত? '

ছোটখালা বলতেন, 'বিয়ের তো বয়স হচ্ছে '

মা বলতেন,' সেদিনই না বিয়ে হলো, . উঠতে বসতে কথা শোনানোর জন্য ঘরে শাশুড়ি, ননদ কিছু নাই, কেন এমন করিস? তুই খুব অধৈর্য রে. '

ছোট খালা সত্যিই ধৈর্য ধরতে পারলেন না। একদিন এক গরীব পরিবার থেকে একটা মেয়ে বাচ্চা নিয়ে এলেন। আর তাই নিয়ে ছোট খালুর সাথে তুমুল গোলমাল শুরু হয়ে গেল। ছোটখালা একদিন সাত সকালে ব্যাগ, বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হাজির।

আমি স্যারের বাসায় পড়তে যাচ্ছি। গেইট থেকে বের হয়ে দেখি ছোটখালা বাচ্চাকে রিক্সাওয়ালার হাতে দিয়ে শাড়ির কুচি মুঠো করে রিক্সা থেকে নামছেন। আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে তাড়া দিলেন, ' যা যা, দেরী হয়ে যাবে তোর '..

যেতে যেতে আমি একবার রিক্সার উপরের ব্যাগ দুটো দেখলাম। বেশ বড়।

স্যারের বাসা থেকেই স্কুলে চলে যেতে হত তখন। বিকালে ফিরে এসে দেখি আমাদের গেটের সামনে ছোট খালুর গাড়ি। ড্রাইভার তার সিটে বসে ঘুম।

গেট পার হতেই বাচ্চার কান্না কানে এলো।

খেয়েদেয়ে উঠে নিজের রুমে যাচ্ছি, ছোটখালা তার রুম থেকে ডাকলেন। ওটাতে ছোট খালা বিয়ের আগে থাকতেন। মাঝে সাঝে বেড়াতে এলেও ওখানেই থাকেন। ওই রুমে শুধু একটা সেমি ডাবল খাট, দুটো মোড়া আর একটা আলনা।

জানালায় পর্দা নামানো ছিল। রুমে ফিলিপ'স এর ১০০ ওয়াটের হলুদ লাইটে রুমের সাদা ছাদ আর দেয়ালের সবুজ ডিস্টেম্পার মলিন। খালার হাতের চুড়ি আর জর্জেট শাড়িতে চুমকির কাজ ঝলমল করছে। বাচ্চাটা হাত পা নেড়ে চাঁপার হাত নিয়ে খেলছে। ফর্সা। বেশি ছোট। আমার কেমন মনে হল সত্যিই ছোট খালার বাচ্চা। খাটের মাথার পাশে সাইড টেবিলের উপর বাচ্চার দুধের টিন, একটা ছোট বেতের ঝুড়িতে ফীডিং বটল, বোতল পরিষ্কারের ব্রাশ, আরো কী কী।

আমাকে রুমের দরজায় দেখেই খালা বিছানার পায়ের দিকের জায়গাটা ইশারায় দেখালেন,'বস, কথা আছে'। আমি মাটিতে পা রেখে খাটে বসলাম। খালা নড়েচড়ে বালিশ কোলে বসলেন। বললেন,' শোন, আপাকে বলবি, আমি আর তোর খালুর ঘরে ফিরে যাব না। এখানেই থাকব। ওই লোক মনে করে আমার যাওয়ার জায়গা নাই। আর শোন, বড় হয়ে যখন বিয়ে করবি তখন মনে রাখবি বউ কুকুর বিড়াল না, ইচ্ছা করলেই কোলে নেয়া আর ইচ্ছা করলেই লাথি দিয়ে বের করে দেয়া যায় না...অমানুষ একটা! বলে, রাস্তার বাচ্চা, কেমন না কেমন রক্ত, জন্মের ঠিক আছে কি নাই! বেয়াদব! আমি জানি না ও নিজে কোন জায়গার? কয়দিন আগেই ওদের ভাংগা ঘরে খাওয়ার ভাত ছিল না, ছিঁড়া কাপড় পরত। এখন উনি বড়লোক! মন এত ছোট থাকলে টাকায় মানুষ বেশি খায় পরে, বড় হয় না! ওই রকম লোকের বাচ্চাও আমার লাগবে না.. ' রাগে ছোটখালার মুখ লাল হয়ে গেল। চোখের পানিটা অপমানের, তা বুঝলাম।

মা ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মেশিন থেকে গুড়া করে আনা মশলা বয়মে রাখছিলেন। আমি খোলা দরজা দিয়ে মা'কে দেখছিলাম। মা সব শুনতে পাচ্ছিলেন। খালাকে কিছু বললেন না। আমাকে বললেন, 'ট্রে' টা ড্রাইভারকে দিয়ে আসো। খাওয়া হলে ওকে বল বাসায় চলে যেতে। তোমার ছোট খালা আজ এখানে থাকবে। '

আমি ট্রে নিয়ে বাইরের বারান্দার কোণায় পড়ার টেবিলে রেখে ড্রাইভারকে ডাকতে বের হলাম।

রাতে খাওয়ার সময় ছোটখালা বাবার কাছ থেকে আমাদের সাথে থাকার অনুমতি আদায় করলেন। বাবা হেসে অনুমতি দিলেন। ছোটখালা সারাদিন কেঁদে চোখ ফুলিয়ে নাক মুখ লাল করে ফেলেছিলেন। দেখলাম, ওই অবস্থায়ই শাড়ির আঁচলে নাক মুছে হাসছেন। মা ও হাসলেন। একটু গম্ভীর। ছোট খালা ঝগড়াঝাঁটি করে আগেও অনেকবার চলে এসেছে। পরদিন হাসিমুখে খালুর পিছন পিছন গাড়িতে উঠে চলে গেছেন।এইবারে কেমন যেন অন্যরকম লাগল।

পড়তে বসে ছোটখালার বলা কথাগুলি ভাবছিলাম। ছোট খালার কথা ভাবছিলাম।ছোটখালা কি সত্যিই আমাদের সাথে থাকবে? খোলা বইয়ে অক্ষরগুলি একসাথে হয়ে কালো লাইনের মত লাগছিল। ভাবছিলাম,'বড় হয়ে কেমন হব আমি?

সেবার ছোট খালা সপ্তাহখানেক ছিলেন আমাদের সাথে। পরের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খালুকে দাওয়াত দিয়ে এনে বাবা কথা বলে মিটমাট করিয়ে দিলেন। ছোট খালা বাচ্চাটি ফেরত দিতে রাজী হলেন না। খালু নাখোশ মনে বাচ্চাটিকে রাখতে রাজী হলেন। খালা তার চেয়ে নাখোশ হয়ে খালুর সাথে যেতে রাজী হলেন। ছোট খালা যাওয়ার সময় চাঁপা বাচ্চাটার জন্য খুব কান্নাকাটি করল। ছোটখালা বাবুর ঝুমঝুমিওয়ালা টুপিটা চাঁপাকে দিয়ে গেলেন। ছোটখালা গাড়িতে উঠার সময় বেচারি ওই টুপিটা হাতে নিয়ে কেঁদে মায়ের হাত ধরল। মায়ের মুখটা দেখে মনে হল মন খারাপ। আমার মনে হল, বিয়ে একটা বিচিত্র সম্পর্ক।

.......

জেনারেল এইচ এম এরশাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন। গুচ্ছগ্রাম, পথকলি ট্রাস্ট সহ নানা রকম কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে দেশে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। টিভিতে দেখানো হচ্ছে। এর আগে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষ্যে টি ভিতে দেখা বিদেশী মুভিগুলি মনে বেশ দাগ কেটেছিল। ঘরে ভি সি আর ছিল। কিন্তু সামনে এস এস সি পরীক্ষা। আমার তখন মুভি তো দূরে থাক, আধাঘন্টার বেশি টি ভি দেখা ও নিষেধ। বন্ধুদের সাথে উঠাবসা ও সীমিত। এমন হাজার রকম নিষেধের দিনেও একদিন টিংকু এসে হাজির। মা ওকে দেখে খুশি হলেন না। ও অসময়ে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। তার উপর মহল্লায় ও যাদের সাথে চলাফেরা করে তাদেরকে মা বাবা ভালো চোখে দেখেন না। আর তাদের আর্থিক অবস্থা ও ভালো ছিল না। আর পরীক্ষার আগে আমি ওর সাথে বসে কথা বলছি এটা মায়ের ভালো লাগল না। আমরা বারান্দায় পড়ার টেবিলে চেয়ার দুটোতে বসে কথা বলছিলাম। মা ঘরের ভিতর থেকে ডাকলেন। বললেন, ' এই সময়টা নষ্ট করলে পরে আর ফিরে পাবে না। ওর তো পরীক্ষা দিতে হবে না। ক্ষতি হলে তোমারই হবে।' টিংকু শুনতে পাচ্ছে ভেবে আমার খুব লজ্জা করছিল। রাগ ও হচ্ছিল। টিংকু অনেক মাস পর আমাদের বাসায় এসেছে।

মা'র সাথে কথা বলে বাইরে এসে দেখি টিংকু উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব কষ্ট হল আমার! আমাকে দেখে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মা বকতে পারেন ভেবে আমিও আর বাধা দিলাম না।

পরদিন কী কারণে স্যার পড়ালেন না। স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে টিংকুর কথা মনে পড়ল। মনটা খুব টানছিল। বইখাতাসহই জেলেপাড়ার দিকে রওনা দিলাম। পথে দেখলাম আমাদের খেলার মাঠে রুক্ষ লালচে চুল আর ময়লা কাপড় পরা কিছু ছেলেমেয়ে খেলছে। স্কুলে যায়না নিশ্চয়। আরেকটু সামনে গিয়ে তেতুল গাছটা। ওটার বয়স কত কে জানে। মোটা শিকড়ের উপর বসে এক রাতে আড্ডা দিয়েছিলাম। কে কে ছিল সেদিন?

জেলেপাড়ার কাছাকাছি হতেই টিংকুর ছোট কাকার ছেলে টুকু আমাকে দেখে এক ছুটে বাড়ির দিকে রওনা হল। একটু পরই দেখি টিংকু আসছে। আমাকে দেখে হাসল। আমরা স্কুলের দিকে হাটতে শুরু করলাম। ক্লাস শুরু হবার আগে মোটামুটি সময় আছে। জিজ্ঞেস করলাম বাসায় সবাই ভাল আছে কিনা। টিংকু মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল, 'আছে'। আমি বুঝলাম, ভালো নেই । আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে হল না। এক দিনে কী আর পড়া হবে? অনেকবার পড়েছি ওসব। স্কুলের পিছনে মাঠের কিনারে ঘাসের উপর বসলাম দুই বন্ধু। স্কুলের সামনে থেকে কেনা ঝাল চানাচুর খেয়ে সকাল ন'টা থেকে স্কুল ছুটি পর্যন্ত প্রাণের যত কথা বললাম। শুনলাম।

টিংকুদের ভিটার খাজনা সম্পর্কিত সমস্যা, টুটুলের বাবার অসুস্থতা থেকে শুরু করে প্রায় সব পুরানা বন্ধুর সুখ দু:খের কাহিনী কম বেশি জানলাম। আমার ও কিছু টিংকু জানল।

আমি হিসাব করে অবাক হলাম, আমার অন্তত: আধ ডজন বন্ধু আছে, যাদের পরিবারের একবেলার বাজার খরচ আর আমার একদিনের টিফিন আর রিক্সাভাড়া সমান!

টিংকুর কংকালসার হাত আর চোয়ালের ভেসে উঠা হাড় দেখে নিজের চেহারা লুকানোর জায়গা খুঁজলাম মনে মনে। মাথা উঁচু করে তাকাতে পারছিলাম না টিংকুর দিকে। সব বন্ধুর চেয়ে ভালো আছি আমি! এক হাতে বন্ধুর হাত ধরে রেখে নিরবে মাফ চাইলাম।

মিথিলা বাবু!

ঐদিন মনে মনে ভাবছিলাম, কেন এই বৈষম্য? সবাই ভালো খেতে পরতে পারবে বলেই তো নাকি এই দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছিল। তবে আজ টিংকুদের কেন এই অবস্থা? এর জন্য দায়ী কে ছিল?

আসলে দেশ স্বাধীনের পরে যুদ্ধবিধবস্ত দেশ পুণর্গঠনের দায়িত্ব বর্তেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর। আরো সোজা ভাষায় বলতে গেলে শেখ মুজিবের ওপর। কিন্তু এই যে একেবারে প্রান্তিক চাষিদেরকে সহ অণ্য ছিন্নমূল মানুষের ভাগ্য ফেরাতে কি আদৌ সেই সময়ে কোনো যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল? *আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি নীতিও দেশবাসীর মঙ্গল বিধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি পূরণের নামে সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বাস্তবে এর ফলে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা কৃষকদের অবস্থার মধ্যে কোন শুভ পরিবর্তন আসতে পারেনি।কারণ, মুজিব আমলে ভূমিহীন এবং (এক একরের কম জমির মালিক) গরীব কৃষকের সংখ্যা ছিল কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী। এদের শেষ সম্বল ছিল একটুখানি ভিটেবাড়ি। কিন্তু সরকার ভিটেবাড়ির খাজনা মওকুফ করেনি। আর তাই নীতিটির মাধ্যমে লাভবানদের শ্রেণী ও সংখ্যাও সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।

সরকারের খাস ও উদ্ধৃত জমির পরিবর্তনই কেবল প্রকৃত কৃষকদের অবস্থা পরিবর্তন করতে পারত। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন ১০০ বিঘা। এর ওপরের জমি রাষ্ট্রায়ত্ব করে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই সাথে পরিবার সম্পর্কে এমন বিচিত্র সংজ্ঞাও ঘোষিত হয়েছিল যে, আইনের ফাঁক গলে যে কেউই ইচ্ছা করলে হাজার বিঘার মালিকানাকে বহাল রাখতে পারত এবং বাস্তবে হয়েও ছিল তাই-ই। বিশেষতঃ জমির সিলিং নির্ধারণ করলেও বেনামী সম্পত্তি আইন ছিল বহাল। আর একারণেই আওয়ামী লীগের শাসনকালে কোন জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এমন একটি প্রমাণ দেখানো যাবে না, যেখানে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে কোন জমি বিতরণ করা হয়েছিল।

ব্যক্তিমালিকানা, তাও ১০০ বিঘা পর্যন্ত, বহাল রেখে বাংলাদেশের মত কৃষি প্রধান বেকারে ভরা ক্ষুদ্র একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা- ভিন্ন সে প্রসঙ্গে না গিয়েও এখানে নীতিটির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য করা দরকার (উল্লেখ্য গণবিরোধী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগ সরকারও ১৯৫০ সালে সর্বোচ্চ জমির পরিমাণ করেছিল ১০০ বিঘা )। অত বিপুল পরিমাণ জমির মালিকের সংখ্যা অবশ্যই ছিল স্বল্প। আওয়ামী লীগ সরকার প্রকৃতপক্ষে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল অবাধ শোষণের অধিকার। এর ফলে বর্গা প্রথার মাধ্যমে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের উপর সামন্ত শোষণকে অব্যাহত রাখার সুযোগ পেয়েছিল।*

আমার বাবু!

আজ অনেকেই নিজ নিজ পছন্দের দলের পক্ষে লেজুড়বৃত্তিসুলভ মনোভাব নিয়ে অনেক কিছুই লিখে যাচ্ছে, সভা-সমিতিতে বুক উচিয়ে মনগড়া কথা যা আসল সত্যকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাবার মত, সেগুলো নিদ্বিধায় বলে যাচ্ছে। তবে আমি তোমাকে আমার লিখনির এই বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত এদেশে রাজনৈতিক দলগুলো আসলেই কি করে এসেছে, সেটা জানানোর চেষ্টা করব।

যা বলছিলাম, *আওয়ামী লীগ সরকার বর্গা ও মহাজনী প্রথাকে উৎসাহিত করে গ্রামাঞ্চলে আধিপত্যকারী একটি শোষক শ্রেণীকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। গরীব ও ভূমিহীন তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের ভালো করার সামান্য চিন্তা থাকলেও সরকার অমন একটি শোষণমূলক ভূমি নীতিকে পরিকল্পনায় আনত না এবং বর্গা প্রথা উচ্ছেদ কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করত। আওয়ামী লীগের দলীয় জোতদার ও ধনী কৃষকদের চাপে ১০০ বিঘার সিলিঙ্গকেও সরকার শেষ পর্যন্ত কার্যকর করেনি।

এই নীতির ফলেই সম্পূর্ণ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে জোতদার ও ধনী কৃষকদের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে তারা ইচ্ছেমত বিভিন্ন পণ্যের, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যকে কমিয়ে আনার সামান্যতম উদ্যোগ পর্যন্ত না নিয়ে দুর্ভিক্ষের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতেও শেখ মুজিব রসিকতা করে বলেছিলেনঃ'কেমন বুঝছেন শহরের সাহেবেরা!'- যেন এই বর্ধিত মূল্যের অর্থ তিনি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন!

কিন্তু বাস্তবে এর সমস্ত সুবিধাই পেয়েছিল জোতদার, ধনী কৃষক এবং লাইসেন্স ও পারমিটপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী এবং কালোবাজারিরা। অন্যদিকে ভূমিহীন ও গরীব কৃষক তথা ক্ষেত মজুরদের অবস্থা যে কত শোচনীয় হয়েছিল তার চিত্র মিলবে এভাবে বলা গেলে। -দেখা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনকালের কোন সময়েই খাদ্য শস্যের মূল্য বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালের কাছাকাছিও থাকেনি। আয় যখন হয়েছে ৯৯ টাকা, মূল্য তখন থেকেছে ১২২ টাকা। এই ব্যবধান সীমা ছাড়িয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। এ সময়ে একজনের আয় ছিল মাত্র ২৬১.৪০ টাকা, আর খাদ্যমূল্য চলে গিয়েছিল ৮৬৯.৫৫ টাকায়। এতো গেলো কেবল খাদ্যের দিকটি। মানুষকে একই সাথে অন্য জিনিসও কিনতে হতো যার দামও ক্রমবর্ধিত হচ্ছিল আকাশ্চুম্বী ভাবে। তার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকার আমলে ও রক্ষা হয়েছিল।*

আমার বন্ধু টিংকুর দরিদ্র পরিবার ভিটেছাড়া হয়েছিল সরকারী এসব আইন আর জেলেপাড়ায় সামন্তবাদী ভূস্বামীদের যৌথ অবদানে।

ভুমি আইনের জটিলতা বোঝার জ্ঞান ও তাদের ছিল না। দুর্বল পরিবার সবলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সবলের পাশে আইনকে দেখে ভয় পেয়েছে। আইনের আশ্রয় তাদের ভাগ্যে জোটেনি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রতিকারহীন অব্যবস্থা কঠিন পাহাড়ের মত অটল। ঘুষ তো উপরি আয় নামে পরিচিত ছিল। তা নিজেদের অধিকার হিসাবেই আদায় করত। যাদের ভাতের চাল কিনার টাকা নাই তারা ঘুষের টাকা কোথা থেকে যোগাড় করবে?

এদের সম্মিলিত অত্যাচারে টিকতে না পেরে জেলেপাড়া ছেড়ে, পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে টিংকুর পরিবার অন্য এক শহরে ভাসমান জনতার দলে নাম লেখায়। টিংকু গোপন পার্টিতে যোগ দেয়। পরে নামধারণ করে ‘গলা কাটা আতিক ‘ নামে।

(ক্রমশঃ)

* রেফারেন্সঃ বাংলাদেশের রাজনীতিঃ প্রকৃতি ও প্রবণতা- ২১ দফা থেকে ৫ দফা ( সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র )

বিষয়: সাহিত্য

১০৫২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

294992
১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪৯
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম........শ্রদ্ধেয় সুহৃদ মামুন ভাইয়া। চমৎকার একটি লিখা পোষ্ট করার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১৪
238434
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম আপু।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বারাকাল্লাহু ফীহ।Good Luck Good Luck
295072
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৩২
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : নিয়মিত এই লেখা না পড়লে ঘুমাতেও পারিনা। তবে অসুস্থতার কারনে নিজের লেখাও নিয়মিত পোস্ট করতে পারিনা দোয়া করবেন যেন নিয়মিত হতে পারি।
ভালোলাগা রেখে গেলাম।
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫৮
238500
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সাথে থেকে সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
আপনি দ্রুত যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, পরম করুণাময়ের কাছে সেই দোয়াই করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
295131
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৪৮
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : মাঝখানের কয়েকটি পর্ব পড়া হয়নি।

এই পর্বটিও ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ।
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩১
238666
মামুন লিখেছেন : সাথে থাকার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
295164
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:১৮
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার লেখা থেকে সেই সময়ের অনেক কিছু জানতে পারছি।
১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩২
238667
মামুন লিখেছেন : সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File